প্রকাশকের কথা
তামাম দুনিয়ায় প্রতি মুহূর্তে উচ্চারিত হচ্ছে একটি নাম-মুহাম্মাদ [সা.]। কোটি কোটি বিশ্বাসী মানুষের বকের গহিনে তার বসবাস। লাখাে-কোটি দরুদ বর্ষিত হচ্ছে তার শানে। দনিয়ার প্রতিটি প্রান্তর থেকে অনুসরণ করছে কোটি মানুষ। তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত নিয়ে বিশ্লেষণ চলছে। বর্তমান সময়ের ভাষায় তিনিই পৃথিবীর ‘বেস্ট সেলিব্রেটি। প্রিয় নবিজির পুরাে জীবনটা দুনিয়াবাসীর কাছে উন্মুক্ত বই। তাঁর জীবন-পৃষ্ঠা উলটিয়ে যা ইচ্ছে আমরা পড়তে পারি, শিখতে পারি। প্রতিটি অধ্যায় মণি-মুক্তোয় ভরপুর। এই মহামানবের সমগ্র জীবন আমাদের হিদায়াতের পথ ও পাথেয়।
পৃথিবীর সকল সেলিব্রেটি অন্তত কিছু না কিছু একান্ত ব্যক্তিগত' বলে গােপন করে। কিন্তু দেখুন না আমাদের নবিজিকে; সবকিছুই তিনি উন্মুক্ত করেছেন উম্মতের জন্য। নবিজির বহির্জীবন নিয়ে বলেছেন সাহাবিগণ, ঘরের জীবন নিয়ে বলেছেন উম্মুল মুমিনিন। তারা নবিজির জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ অনুসরণ করেছেন এবং সেগুলাে দুনিয়াবাসীর সামনে তুলে ধরেছেন। এমনভাবে নবিজিকে রেকর্ড করা হয়েছে, সাড়ে চোদ্দোশাে বছর পরেও মনে হয় যেন, তিনি এই তাে কিছুদিন আগে আমাদের ছেড়ে রাব্দুল আলামিনের সান্নিধ্যে চলে গেলেন। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আমাদের বাবা-মা কিংবা শিক্ষকের চেয়েও নবিজিকে বেশি জানি। অনেক ক্ষেত্রেই আমরা নিজেদের চেয়েও নবিজিকে বেশি উপলব্ধি করতে পারি এবং ভালােবাসি। আমাদের ধ্যান-জ্ঞান এবং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ‘উসওয়াতুন হাসানা’ প্রিয় নবিজি। নবিজির জীবন নিয়ে বাংলা ভাষায় বেশকিছু কাজ হয়েছে, সামনে আরও হবে। গার্ডিয়ান সচেতনভাবেই বাংলা সিরাহ নিয়ে এই কাজটা পাঠকদের হাতে তুলে দিচ্ছে। ধরে নিন, সিরাহ সমুদ্রে এটা এক ফোটা পানি মাত্র। সমুদ্রে এক ফোটা পানি ঢেলেছেন বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামিক স্কলার, সৌদি আরবের কারাবন্দি মজলুম আলিম ড. সালমান আল আওদা। আমরা দুআ করছি, রাম্বুল আলামিন তাঁকে হিফাজত করুন। এই গ্রন্থ প্রচলিত সিরাহ নয়; নবিজির জীবনের সাথে আমাদের প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে ফেরার এক প্রচেষ্টার নাম ‘মাআল মুস্তফা। গ্রন্থটির অনুবাদ করেছেন তরুণ অনুবাদক জনাব ফারুক আজম। লেখক, অনুবাদক এবং গ্রন্থটির নির্মাণ প্রক্রিয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। ‘মাআল মুস্তফা’ গ্রন্থে আমরা নবিজিকে আরেকবার জীবনের সাথে মিলিয়ে নেব, তাঁর জীবন থেকে পাথেয় কুড়িয়ে নেব, ইনশাআল্লাহ।
নূর মােহাম্মাদ আবু তাহের বাংলাবাজার,
ঢাকা ১০ নভেম্বর, ২০২০
অনুবাদকের কথা
পৃথিবী তখন ঘাের অমানিশায় আচ্ছন্ন। চারদিকে অন্ধকারের কালাে থাবা। অন্যায়-উৎপীড়ন, অনিয়ম- অবিচার, জুলুম-অত্যাচারের জাঁতাকলে পিষ্ট সমাজ জীবন। কোথাও কোনাে নিয়ম নেই, নেই সুবিচারের নিশ্চয়তা। বাহুবল ও পেশিশক্তি সেখানে শেষ কথা। ক্ষমতার জোর ও প্রতিপত্তির দণ্ডের কাছে ডুকরে কেঁদে উঠে মানবতা। অধিকারহারা মানুষের চাপা আর্তনাদ বাতাসে মিলিয়ে যায়। বঞ্চিত ও শােষিত শ্রেণির অস্ফুট স্বর শােষকের গর্জনের কাছে ক্ষীণ হয়ে আসে। নিষ্ঠুর সমাজ নির্বিকার তাকিয়ে রয়। পাথুরে হৃদয়ে কি আবেগের ঢেউ খেলে? মরুভূমির শূন্য বিয়াবানে কি শীতল জলের ধারা পাওয়া যায়? সেখানে তাে কেবল খরখরে শূন্যতা। মরুচারী বেদুইনরাও হয়ে গিয়েছিল মরুভূমির মতােই; ফাপা, অন্তঃসারশূন্য আর কঠোর। মরুচারী বেদুইনরা ছিল স্বেচ্ছাচারী, উন্মাদ। বেপরােয়া বল্গাহীন তাদের জীবনধারা। কথায় কথায় নাঙ্গা তলােয়ার হাতে দাঁড়িয়ে যাওয়া কিংবা সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিপক্ষের মস্তক উঁড়িয়ে দেওয়া ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে বেড়াত যুদ্ধ-হানাহানির অভিশাপ। মৃত্যুকালে পিতা পুত্রকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার, প্রতিশােধ নেওয়ার অসিয়ত করে যেত। এমনই ছিল তাদের প্রতিশােধস্পৃহা, প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষোভ ও রােষ। অবলীলায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিত। এমনই বােকা, নির্বোধ ও প্রতারিত ছিল তারা। তাদের এই আত্মঘাতী জীবনাচার দেখে যেকোনাে বিবেকবান মানুষের হৃদয় সমবেদনা ও করুণায় ভরে উঠবে। মানুষেরই যদি তাদের দেখে দয়া হয়, তাহলে মানুষের রবের কেমন হবে; যার দয়ার ভান্ডার সমুদ্রের অথই জলরাশির চেয়েও বেশি। আল্লাহর দয়া হলাে। সেই দয়ার প্রস্রবণ ধূলির ধরায় নেমে আসে। আবির্ভাব হয় মহামানবের, রাহমাতাল্লিল আলামিনের। মরুভূমিতে প্রাণ ফিরে আসে। উষর রুক্ষ পৃথিবী সুফলা হয়ে ওঠে। এ যেন ফুলফোটা পাখিডাকা বসন্তের আগমন! চারদিকে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। উৎসবের আমেজ শুরু হয়। চারদিকে খুশির ঝিলিক। আমিনার গৃহে এক চাঁদের টুকরাে জন্ম নিয়েছে। বৃদ্ধ আব্দুল মুত্তালিবের মনে বাঁধভাঙা উল্লাস। তিনি তড়িঘড়ি করে কাবার পথে পা বাড়ালেন। আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। তাঁর চাঁদের টুকরাে নাতির নাম রাখলেন মুহাম্মদ-প্রশংসিত। সবাই এসে জিজ্ঞেস করলেন—“আচ্ছা আব্দুল মুত্তালিব! আপনি কোনাে পূর্বপুরুষের নামে নাতির নাম রাখলেন না কেন?’ আব্দুল মুত্তালিবের স্পষ্ট জবাব—‘আমার ইচ্ছে—আসমান-জমিনের সবাই আমার নাতির প্রশংসা করুক। সমগ্র জাহান তাঁর প্রশংসায় মুখর হােক। তাই আমার নাতির নাম হবে মুহাম্মদ-প্রশংসিত। সময় বয়ে চলে। আমিনার গৃহের সেই নবজাতক ধীরে ধীরে বড়াে হয়ে ওঠে। যে-ই তাঁকে দেখে, তাঁর মায়াময় চেহারার মায়ায় পড়ে। তার কোমল আচরণের, অনুপম গুণাবলির প্রেমে মাতােয়ারা হয়ে যায়। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলে তাঁর গুণমুগ্ধ অনুরাগীর সংখ্যা। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে উঠেন সবার আস্থা ও ভরসার পাত্র; এমনকী ঘাের শত্রুর কাছেও রাসূল ছিলেন পরম বিশ্বস্ত বন্ধু। হয়ে উঠলেন পৃথিবীর জন্য অনুকরণীয় আদর্শ-উসওয়াতুন হাসানা। এই মহান বিপ্লবী ও সংস্কারকের জীবনের টুকরাে টুকরাে ঘটনা এবং তার শিক্ষা নিয়েই রচিত হয়েছে মাআল মুস্তফা। এটা কোনাে গড়পড়তা সিরাত গ্রন্থ নয়। নবি-জীবনের আদ্যোপান্ত বিবরণও এখানে পাবেন না। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ঘটনার ধারাবাহিকতাও এখানে রক্ষা করা হয়নি। কিছুতেই এই বই বাজারের আর দশটা সিরাত গ্রন্থের সাথে মেলে না। এই বই সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। এর আঙ্গিক ও বিন্যাস, মাত্রা ও ধরন সম্পূর্ণ আলাদা। এই বইয়ে রাসূলের জীবনের নানা দিক, নানা রূপ ফুটিয়ে তােলা হয়েছে। জীবনের নানা সংকট, সমাজের নানা টানাপােড়েন, সমগ্র বিশ্বের বিভিন্ন সমস্যার সঠিক ও সুষ্ঠু সমাধান খোঁজা হয়েছে এই গ্রন্থে। তাই এই গ্রন্থ সাধারণ কোনাে নবি-জীবনী তাে নয়-ই; বরং রুগ্ণ মানবতার তরে এক মহা পথ্য-প্রেসক্রিপশন; যার সেবন ও অনুসরণে তার সুস্থতা ও আরােগ্য রয়েছে। শুধু তাই নয়; পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র সবকিছুর মূলেই যেহেতু মানুষের জীবন, সেই জীবনের পরতে পরতে যে বাধা ও বিপত্তি রয়েছে, তার মহৌষধ হলাে এই গ্রন্থ। এখানেই শেষ নয়; আরও আছে। মুসলিম বিশ্ব আজ কোন সমস্যায় জর্জরিত, কী তার সমাধান? ফিলিস্তিন সংকটের উত্তোরণ কোন পথে? ইসলামি দল ও মুসলিম শাসকদের সমস্যা কোথায়? মুসলিম স্কলারদের চিন্তার প্রান্তিকতার কারণ এবং অনেক ক্ষেত্রে একমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পেছনে দায়ী কেএন্তার সব বিষয়ের সমাধান খোঁজা হয়েছে সিরাতের শীতল ছায়ায়। এক ধাপ বাড়িয়ে বলতে পারি-মুসলিম জীবনের প্রাত্যহিকতা থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পর্যায়ের বিপর্যয় পর্যন্ত মােটামুটি সব বিষয়কে সিরাতের জ্যোতিতে দেখার এক প্রয়াশই হলাে এই গ্রন্থ।
ফারুক আযম ৪ নভেম্বর, ২০২০
ভাসে চোখের তারায় তারায়—এক
নবিজির জীবন : বইয়ের খােলা পাতা মুহাম্মাদ [সা.] শেষ নবি। আল্লাহ তায়ালা তাঁকে দিয়ে নবুয়তের সমাপ্তি করেছেন। কুরআনে ইরশাদ হয়েছে—
‘তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবি।' সূরা আহজাব : ৪০
আল্লাহ তায়ালা তাঁকে সমগ্র মানবতার জন্য আদর্শরূপে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন‘তােমাদের মাঝে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অনেক বেশি স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূল -এর জীবনে রয়েছে উত্তম আদর্শ।' সূরা আহজাব : ২১
এই আয়াত থেকে একটা ব্যাপার স্পষ্ট হয়, রাসূল -এর জীবন তার চারপাশের সকলের জন্য ছিল বইয়ের খােলা পাতার মতাে; বন্ধু ও শত্রু, পুরুষ ও নারী, বড়াে ও ছােটো, কাছের ও দূরের নির্বিশেষে সবার কাছেই তাঁর জীবন ছিল স্পষ্ট, পরিষ্কার। কোথাও কুয়াশার আচ্ছন্নতা নেই; বরং রােদ ঝলমল দিনের মতােই উজ্জ্বল। সবাই তার জীবনের খুঁটিনাটি জানত; তাঁর ব্যক্তিগত ও সাধারণ ব্যাপারগুলাে নিয়েও প্রত্যেকে ওয়াকিবহাল ছিল। তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার যা বাইরের মানুষের পক্ষে জানা দুরূহ ছিল, সেগুলােও উম্মুল মুমিনিনরা মানুষের স্বার্থে সবিস্তারে সবার কাছে। পৌছে দিতেন; বিন্দুবিসর্গও বাদ পড়ত না। অথচ ব্যাপারগুলাে ছিল একান্তই ব্যক্তিগত। তাই আজ আমরা দীর্ঘতর সময় পরও তাঁর অন্দরমহলের খবরগুলাে জানি। তাঁর খাওয়া ও পান করার শিষ্টাচার, সফরের ধরন ও ঘরের রুটিন, জাগরণের অবস্থা এবং বিছানায় ঘুমানাের পদ্ধতি; এমনকী তাঁর প্রাকৃতিক প্রয়ােজন সারার কথাও আমাদের কাছে অবিদিত নয়।
মানুষের জীবনের অনেক ছােটোখাটো ব্যাপার থাকে, থাকে একান্ত কিছু বিষয় যা আমরা তেমন গুরুত্বের চোখে দেখি না কিংবা তা নিয়ে খুব একটা ভাবিও না। অনেক বড়াে বড়াে মানুষ এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনে এমন অনেক ছােটোখাটো ব্যাপার থাকে—যা আমাদের নজর এড়িয়ে যায়, সেসবের প্রতি ক্ষেপও করি না। আমাদের খুব কাছের মানুষ, খুব কাছের আপনজন, বাবামা কিংবা শিক্ষকদের জীবনের ছােটোখাটো ও সাধারণ বিষয়গুলাে আমাদের চোখে পড়ে না।। এমনকী নিজেদের জীবনেও এমন ছােটোখাটো ব্যাপারগুলাে নিয়ে আমরা তেমন একটা আগ্রহী না। আমরা অনেকেই হালকাচালে লঘু মেজাজে অনেক কাজ করি ফেলি। আর সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে বলি—“আমি তাে এত ভেবে করিনি। আবার অনেক সময় কৃতকর্মটির সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা নিয়ে আড়ষ্টতা বােধ করি। কিন্তু রাসূল -এর জীবনের সবকিছু; ছােটো থেকে ক্ষুদ্র বিষয়ও আমরা সবিস্তারে জানি। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তাঁর জীবনটা আমরা জানি; তা যেন বইয়ের খােলা পাতা। তাঁর জীবনে কোথাও কোনাে খাদ নেই। সর্বাঙ্গ স্বচ্ছ এক অনিন্দ্যসুন্দর জীবন!
সংরক্ষিত জীবনী মহান আল্লাহ ঘােষণা দিয়েছেন, রাসূলের জীবন সংরক্ষণের; একেবারেই সবিস্তারে, খুঁটিনাটিসহ। আপনি যখন রাসূলের জীবনীর ওপরে লেখা মৌলিক গ্রন্থগুলাে হাতে নেবেন-যেমন : ইমাম তিরমিজির আশ শামায়েল আল মুহাম্মাদিয়া এবং আলবানির মুখতাসারা ইত্যাদি, অবাক নয়নে দেখবেন-সেখানে তাঁর জীবনের আদ্যোপান্ত বর্ণনা করা আছে। এমনকী সেসব গ্রন্থগুলােতে চুলে। ও মাথায় পাক ধরার মতাে তুচ্ছ বিষয়েরও যথাযথ বিবরণ আছে। হজরত আনাস থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন‘আমি নবিজির চুলে ও মাথায় গুণে গুণে চোদ্দোটি শুভ্র চুল পেয়েছি।' মুখতাসারুশ শামায়েল
অন্য বর্ণনায় এসেছে‘তাঁর মাথায় ও চুলে বিশটিও শুভ্র কেশ নেই।' বুখারি ৩৫৪৭, ৩৫৪৮, ৫৯০০
অন্য বর্ণনায় আছে ‘যখন আল্লাহ রাসূল -কে তুলে নেন, তখনও বার্ধক্য তাঁর ওপর একেবারে জেঁকে বসেনি। ওফাতের দিন তাঁর চুল ও দাড়ি মিলে ৩০টির বেশি পাকা চুল পাওয়া যায়নি। কাশফুল মুশকিল ৩/২২২
নবিজির জীবনী এতটাই সংরক্ষিত, তাঁর পাকা দাড়ি ও চুলে সংখ্যাও গ্রন্থভুক্ত হয়েছে; এমনকী সেই কেশগুলাের অবস্থানও নির্ধারিত আছে! সিরাতে নববির সবচেয়ে সুন্দর ও উজ্জ্বল দিক হলাে—এসব সংরক্ষণের নিশ্চয়তা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালাই দিয়েছেন। তিনি মানুষের জন্য নবিজির চরিত্র আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করার ঘােষণা দিয়েছেন। মহান আল্লাহ শতাব্দীর পর শতাব্দী এক অনুপম রীতিতে সিরাতে নববির সংরক্ষণ করেছেন। এই উম্মাহর আলিম, ইতিহাসবিদগণ সিরাত সংরক্ষণে সীমাহীন গুরুত্ব দিয়েছে। আর এই কাজে তারা পূর্ববর্তী সকল জাতিকে পেছনে ফেলেছেন। এই ময়দানে মুসলিম উম্মাহর সঙ্গে অন্য কোনাে জাতির তুলনাই চলে না। অন্যান্য জাতি নিজেদের নবি ও রাসূলের ব্যাপারে যা লিখেছে, তা মুহাম্মাদ মুস্তফা -এর ওপর লিখিত গ্রন্থের তুলনায় অতি নগণ্য! আপনি যদি কোনাে ইহুদিকে মুসা [আ.]-এর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন, সে বড়ােজোর কিছু দুর্বল ও বিক্ষিপ্ত কথা বলতে পারবে। সে কথার না আছে কোনাে ভিত্তি, আর না আছে কোনাে বাস্তবতা। কিন্তু মুসলিম আলিমগণ রাসূলের জীবনের অতি ক্ষুদ্র ও সামান্য ব্যাপারেও নিপুণ বর্ণনা দিয়েছেন। সে বর্ণনার পরম্পরা অতি নিখুঁত ও নির্ভেজাল; কোথাও কোনাে কালিমার লেশ নেই। বর্ণনাকারীদের নামও অতি যত্নে গ্রন্থভুক্ত করা হয়েছে। এমনকী সেই যুগে বর্ণনাকারীদের প্রায় পাঁচ লাখ নাম পাওয়া যায়! অথচ এই মহান আলিমদের কাছে কোনাে ল্যাপটপ, কম্পিউটার, টাইপরাইটার ইত্যাদি উন্নত ছাপার যন্ত্র ছিল না। কিন্তু তাঁদের স্মরণশক্তি ও মুখস্থ করার ক্ষমতা ছিল অভাবনীয়। এমনকী এই স্মরণশক্তি এতটাই প্রখর ছিল যে, যা বর্তমানে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির উৎকর্ষতাকেও হার মানায়। তাঁদের এই প্রখর স্মরণশক্তি ও অমানুষিক শ্রম ব্যবহৃত হয়েছে রাসূলের সুন্নাহ ও নির্দেশনাকে সংরক্ষণে, তাঁর জীবনীর সুরক্ষায়।
নিষ্কলুষ জীবনী আল্লাহ তায়ালা রাসূল [সা.] -কে সৃষ্টি করেছেন এবং তাকে দিয়েছেন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা। তাঁর প্রতিটি কথা, কাজ এবং তাঁর ভেতর-বাহিরকে স্বচ্ছ ও পবিত্র করেছেন। “সিরাত পড়তে গিয়ে যে ব্যাপারটা সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে তা হলাে—সমগ্র সিরাতই ভালােবাসা ও প্রীতির দিকে আহ্বান করে; এমনকী তাঁর বাহ্যিক রূপও। আপনি যখন নবিজির সমস্ত দেহাবয়ব ও আকৃতির পূর্ণ বর্ণনা পড়বেন, যেমন : তাঁর চুল, বাহ্যিক রূপ, চেহারার সৌন্দর্য, পােশাক-পরিচ্ছদ, আকৃতি-অবয়ব ইত্যাদি, তখন আপনার হৃদয় ভালােবাসায় পূর্ণ হয়ে উঠবে। প্রাণ ভরে উঠবে ঈমানি শক্তিতে। রাসূল -এর চরিত্র, আচার-ব্যবহার এবং মানুষের সঙ্গে লেনদেন ছিল আরও আশ্চর্যের। তাঁর সবকিছুই সম্প্রীতির সৃষ্টি করে। তাঁর প্রতি ভালােবাসা বাড়িয়ে তােলে। আর তাঁর প্রতি ভালােবাসা পােষণ করা ঈমানের আলামত। মুহাম্মাদ-এর নামে সাক্ষ্য দেওয়ার দাবিই হলাে—তাঁর প্রতি সত্য ও স্বচ্ছ ভালােবাসা পােষণ করা।
সিরাত পাঠে ভালােবাসার সৃষ্টি নিঃসন্দেহে সিরাত পাঠ এবং সিরাত গবেষণায় এই ভালােবাসার সৃষ্টি হবে। বড়ােই পরিতাপের বিষয়—যদি দৈনন্দিন তাসবিহ পাঠের মতােই সিরাতের নির্দিষ্ট কোনাে অংশ পড়া হতাে, প্রতিদিনের জন্য একটা অংশ নির্ধারিত থাকত, তাহলে রাসূলের সাথে ভালােবাসার বন্ধন তৈরি হতাে; শুধুই নামের অনুসরণ হতাে না। রাসূলের জীবনের নানা পর্যায় ও পরিবর্তনের সাথে পরিচয় ঘটত, তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছুই জানা হতাে। তার দিনাতিপাতের ধরন ও প্রকৃতি, কার্যাবলি ও নানা অবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেত। আর প্রকৃত ব্যাপার। হলাে—আল্লাহর রাসূল সম্পর্কে যত বেশি জানা যাবে, হৃদয় ও মন তাকে অনুসরণের জন্য তত বেশি ব্যাকুল হয়ে উঠবে। এখনকার সময়ে দেখুন, অনেক মুসলিম যুবক স্যাটেলাইট টিভি চ্যানেল, ইন্টারনেট, ইউটিউব, সামাজিক যােগাযােগ মাধ্যমের কল্যাণে অনেক তারকা, ক্রীড়াবিদ, অ্যাথলেটদের ‘লাইফস্টাইল সম্পর্কে জানে। তাদের সম্পর্কে বেশ ধারণা রাখে এবং তাদের অন্ধভাবে অনুকরণ করে। শুধু অনুকরণই নয়; বরং অনেকে আছে যারা অনুকরণের ব্যাপারে বাড়াবাড়ি করে। এর মূল কারণ হলাে—প্রতিনিয়তই তাদের দেখা ও পর্যবেক্ষণ করা, তাদের জীবন ও জীবনের গতিবিধি সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা।
আজ রক্ষণশীল সমাজে বেড়ে ওঠা, দ্বীনদার পরিবারে জন্ম নেওয়া কোনাে তরুণীর দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। তার পােশাকে, চুলের বিন্যাসে, কাজের ধরনে, ভাষার ব্যবহারে এবং হাস্যরসিকতায় কথিত ‘মডেল’ ও ‘স্টার’দের অন্ধ অনুকরণ দেখা যায়। তার স্বপ্নের মানুষ হলাে শিল্পী, সিনেমা তারকা কিংবা টেলিভিশনের উপস্থাপিকা। তাদের অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে তার স্বপ্ন, ব্যক্তিত্বের গঠন ও বিকাশ হচ্ছে। তার পছন্দের মডেলই একমাত্র তার অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব। বর্তমানে এটাই অধিকাংশ মুসলিম তরুণদের মনের অবস্থা। কারণ, তার কাছে এর চেয়ে উত্তম আদর্শের সন্ধান জানা নেই। এর চেয়ে আলােকিত প্রদীপ্ত জীবনের মশাল হাতে এগিয়ে আসা কোনাে মডেলের খোঁজ নেই। তার টেবিলে পড়ে আছে হাল সময়ের তারকাদের অর্ধনগ্ন ছবিপূর্ণ ম্যাগাজিন। অধুনাকালের ফ্যাশন শােতে অংশ নেওয়া যুবতিদের কিম্ভুতকিমাকার অঙ্গভঙ্গি। তাই এদের কাছে তুলে ধরতে হবে রাসূলের হেরার জ্যোতিতে ভাস্বর দীপ্তিময় জীবন, ওহির আলােয় স্নাত জীবনের সুখ ও সমৃদ্ধি। সিরাতের শিক্ষা ও কুরআনের দীক্ষাই পশ্চিমা আকাশ সংস্কৃতির বানে ভেসে যাওয়া তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে পারে। দিশাহীন পথভােলা পথিককে প্রকৃত গন্তব্যের দিশা দিতে পারে।
সিরাতের সাথে প্রজন্মের সম্পর্ক উন্নয়ন এই প্রজন্মের কাছে আমাদের দায় আছে। তাদের কাছে আমাদের গৌরবময় অতীত এবং সমৃদ্ধ ইতিহাস তুলে ধরতে হবে। মুহাম্মাদ -এর সমুজ্জ্বল জীবনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। আমরা যদি আমাদের সন্তান ও নতুন প্রজন্মের কাছে রাসূলের জীবনী ও ব্যক্তিত্ব সঠিকরূপে উপস্থাপন করতে পারি, তাহলে তারা সিরাত পাঠের প্রকৃত স্বাদের সন্ধান পাবে। বিকল্প খুঁজতে যাবে না। অলীক, কৃত্রিম সারবত্তাহীন ক্ষণস্থায়ী বস্তুর পেছনে ছুটে জীবনের অপচয় করবে না।
ভাসে চোখের তারায় তারায় দুই
সাহায্য করুন প্রতিদ্বন্দ্বীকেও কবি বলেন
‘মুহাম্মাদ আপন দাওয়াত দিয়ে পৃথিবীকে মুক্ত করেছে, তাদের দেখানাে পথে আমাদের জন্য রয়েছে শক্তি ও প্রাণ, তিনি না হলে আবু জাহেলরা আমাদের পথভ্রষ্ট করেই যেত,
আবস এবং জুবইয়ান গােত্র রক্তের বন্য বয়ে দিত!' [কবি ওয়ালিদ আল আজমি]
রাসূল -এর সিরাতের কোথাও কোনাে অস্পষ্টতা নেই। নেই কোনাে গােপনীয় ব্যাপার; বরং রাসূলের সিরাত যেন খােলা গ্রন্থ, সুস্পষ্ট কিতাব। মক্কায় পৌত্তলিক মুশরিকরা তাঁকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরেছিল। মদিনায় তাঁর চারপাশে ছিল ইহুদি, মুনাফিক ও পৌত্তলিকরা; বরং সমগ্র আরব উপদ্বীপই ছিল পৌত্তলিকতার বিস্তৃত প্রান্তর, ক্রীড়াভূমি। মক্কার উপকণ্ঠে প্রতিমা স্থাপিত ছিল। শত্রুরা তাঁকে শেষ করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র আটছিল! অথচ রাসূল সু তাদের ক্ষমা করে দেন। মক্কা বিজয়ের দিন গণক্ষমা ঘােষণা করেন। সারা জীবন যারা তাঁকে হত্যা করতে নানা অপকৌশল এঁটেছিল, তাদের অকুণ্ঠচিত্তে সাহায্য করেছেন।
নবিজির প্রতি কুরআনের সতর্কবাণী আপনি রাসূলের ঘরের অবস্থা দেখে অবাক হবেন। কুরআন ঘােষণা করছে‘স্মরণ করুণ! আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাঁকে বলছেন—“আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখুন এবং আল্লাহকে ভয় করুন।” আপনি অন্তরে যা গােপন করেন, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। আপনি মানুষের ভয় করছেন, অথচ আল্লাহকে ভয় করা অধিক সংগত।' সূরা আহজাব : ৩৭
মনে করুন আপনার পিতা বা ‘শাইখ’ একটা ভরা মজলিসে আপনার উদ্দেশ্যে বললেন-“হে অমুক! তুমি এমন কিছু ব্যাপার গােপন করছ, যা আল্লাহ ফাঁস করে দেবেন। তুমি মানুষকে ভয় করছ, অথচ আল্লাহকে ভয় করা অধিক সংগত।' তখন আপনার অনুভূতি কেমন হবে? নিশ্চয় কুণ্ঠাবােধ, অস্বস্তি ও চাপা ভয় ঘিরে ধরবে। আপনি ভাববেন, এ কথা বলার উপযুক্ত জায়গা তাে এটা নয়। কথাটা তাে একান্তে বলা উচিত ছিল।
অথচ এই মহান নবিকে সপ্তম আসমানের ওপর থেকে তার প্রভু আহ্বান করছেন, তাও আবার কুরআনের মাধ্যমে-যার তিলাওয়াত কিয়ামত অবধি চালু থাকবে। আল্লাহ বলছেন
‘আপনি হৃদয়ে যা গােপন করেন, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। আপনি মানুষকে ভয় করছেন, অথচ আল্লাহকে ভয় করাই অধিক সংগত।' সূরা আহজাব : ৩৭
তারপর রাসূল ৬ যুবক, বৃদ্ধ, নব মুসলিম নির্বিশেষে সকল সাহাবাদের সেই আয়াত পড়ে শােনান। তাঁরা এই আয়াত তিলাওয়াত করবে, নামাজে পড়বে এবং মানুষের কাছে তুলে ধরবে। বিভিন্ন বইয়ে লেখা হবে। মুশরিক, মুনাফিক, ইহুদিরাও শুনবে, যারা তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে রত। এত কিছুর পরও নবিজি এতটুকুও বিচলিত হননি। এসবের প্রতি ভ্রুক্ষেপই করেননি। একটিবারের জন্যও ভাবেননি, শত্রুরা এই আয়াত ব্যবহার করে তাঁকে মন্দ বলতে পারে, কুৎসা রটনা করতে পারে, তাঁর শুভ্র-স্বচ্ছ জীবনে কালিমা লেপন করতে পারে। রাসূলের সিরাত একেবারে খােলামেলা, স্পষ্ট। কোথাও কোনাে জটিলতা নেই। তার ওপর অবতীর্ণ আল্লাহর বাণীর কিছুই তিনি লুকাননি। আয়িশা vg বলেন
‘যদি রাসূল তাঁর ওপর অবতীর্ণ আয়াতের কোনাে কিছু গােপন করতে চাইতেন, তবে এই আয়াত গােপন করতেন—“স্মরণ করুণ! আল্লাহ যাকে অনুগ্রহ করেছেন এবং আপনিও তাঁর প্রতি অনুগ্রহ করেছেন, আপনি তাকে বলছেন-“আপনি আপনার স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখুন। এবং আল্লাহকে ভয় করুন। আপনি অন্তরে যা গােপন করেন, আল্লাহ তা প্রকাশ করে দেন। আপনি মানুষের ভয় করছেন, অথচ আল্লাহকে ভয় করা অধিক সংগত।' সূরা আহজাব : ৩৭
এখানেই শেষ নয়। একবার অন্ধ সাহাবি আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম নবিজির কাছে এলেন। তিনি নবিজিকে উদ্দেশ্য করে বললেন—‘আল্লাহ আপনাকে যা শিক্ষা দিয়েছেন, আপনি আমাকে তা শিক্ষা দিন।
মুসলমানদের সম্ভ্রম
তিনি যেন আমাদের দেখছেন রাসূল -এর অনেক অলৌকিক ঘটনা ও মুজিজা রয়েছে। তাঁর একটি উল্লেখযােগ্য ও বিস্ময়কর মুজিজা হলাে—বিদায় হজের ভাষণে রাসূল -এর বক্তব্য : ‘মানুষের কাছে নিশ্ৰুপ ও নীরব থাকা কামনা করাে। কারণ, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হবে। রাসূল ধীরে ধীরে দাঁড়ালেন। তারপর বলিষ্ঠ কণ্ঠে বললেন—‘আমার মৃত্যুর পরে তােমরা কাফির হয়ে যেয়াে না। তােমরা তখন একে অপরের গর্দান কাটবে।' এই কথার মাঝে একটা প্রচ্ছন্ন আভাস আছে-অচিরেই মুসলমানরা একে অপরের রক্ত চুষতে উদ্যত হবে। এক মুসলিম অবলীলায় অন্য মুসলিমের জীবন নাশ করবে। তার ব্যাপারে নানা ব্যাখ্যা-অপব্যাখ্যা দাঁড় করাবে। অথচ রাসূলের সমস্ত হাদিস পড়লে জানা যায়, ইসলামে কোনাে প্রকার ‘হবে, হতে পারে’র স্থান নেই। ইসলামের সব বিধান স্পষ্ট। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে
‘মুমিন অবৈধ হত্যাকাণ্ডের জন্য নানা ছুঁতাের আশ্রয় নেবে, দ্বীনের ভেতর নানা ফাঁকফোকর খুঁজবে। মুমিনকে অভিশাপ দেওয়া তাকে হত্যা করার মতােই অপরাধ। সহিহ বুখারি : ৬৮৬২.
বরং রাসূল বলেছেন—“মুমিনকে হত্যা করা একপ্রকার কুফুরি। তার মানে এই নয়, কেউ মুমিনকে হত্যা করলে সে সরাসরি কাফির হয়ে যাবে। কিন্তু সে কাফিরদের মতাে কাজ করল। ইসলামপূর্ব যুগে আরবরা একে অপরকে হত্যা করত, একে অপরকে গােলাম বানাত। ইতিহাসের পাতায় আরবদের শত্রুতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতের চিত্র পাওয়া যায়। যেমন : বসুসের যুদ্ধ, দাহিসের যুদ্ধ, গাবরার যুদ্ধ ইত্যাদি। যে লােকগুলাে নববি এই শিক্ষা পেয়েছে, তাদের মাঝে মুসলমানদের সঙ্গে শত্রুতা করা এবং তাদের রক্ত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার ব্যাপারে একটা তীব্র স্পর্শকাতরতা দেখা যায়। এমনকী এমন কাজে তারা প্রচ্ছন্নভাবেও জড়িত থাকতে চায় না। প্রকৃত নববি আদর্শে অনুপ্রাণিত মুসলিমরা এই ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে।
একবার এক লােক রাসূল -কে বলল-“হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহকে ভয় করুন।' তখন এক সাহাবা রেগে গিয়ে বলল-“হে আল্লাহর রাসূল! আমি কি এই লােকের গর্দান উড়িয়ে দেবাে? তিনি বললেন-“না, হতে পারে সে নামাজি। নামাজ মুসলমানদের জীবন রক্ষা করে, তাই হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে কোনাে প্রকার অপব্যাখ্যা দেওয়া যাবে না। একদিন কিছু তরুণ আমাকে বলল—এই লােকগুলাে মুনাফিক। আমি বললাম- ‘ধরেই নিলাম তারা মুনাফিক, কিন্তু রাসূল কি কখনাে কোনাে মুনাফিককে হত্যা করেছেন? কখনােই না; বরং তাদের সুরক্ষা দিয়েছেন এবং মানুষকে তাদের হত্যা করতে বারণ করেছেন। বলেছেন—“মানুষ। যেন এই কথা বলতে না পারে, মুহাম্মাদ তাঁর সাহাবাদের হত্যা করে।” ইসলামের ইতিহাসের পাঠকমাত্রই এই কথা জানে—যারা রাসূল শিক্ষা ও হিদায়াতের মূল মর্ম বুঝেছে, তারা মুসলমানদের রক্তপাত ও তাদের মর্যাদাহানি করাকে জাহান্নামের ‘সুড়ঙ্গ’ ভেবেছে। অথচ আজ নানা অপব্যাখ্যার আশ্রয় নিয়ে বেপরােয়াভাবে মুসলমানদের মান-মর্যাদা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। কখনাে কখনাে নিছক দুনিয়াবি স্বার্থের জন্য মুসলমানদের সম্মানহানি করা হয়, অবলীলায় হত্যা করা হয়। মুসলমানদের ইতিহাস মাজহাবি দ্বন্দ্বে, গােত্রগত শত্রুতায়, মুসলিম রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে, দলে দলে কোন্দলে ভরে গেছে। এই অহেতুক কাজে কত শত মুসলমান লাশ হয়েছে, জীবনের মায়া ত্যাগ করেছে। অথচ ওই লােকটা সম্পূর্ণ ঔদ্ধত্য, কদর্যতা ও শালীনতা বিবর্জিত পন্থায় রাসূল -কে বলেছিল—“হে মুহাম্মাদ! সুবিচার করাে।' অন্য একদিনে ঘটনা। একবার রাসূল -এর কাছে এক লােক এলাে। নবিজি এক প্রসঙ্গে শপথ করলেন। তখন আগত লােকটা বলে উঠল—এই কসমে আল্লাহর সন্তুষ্টি কামনা করা হয়নি। তখন রাসূল বললেন-‘আল্লাহ মুসা -কে রহম করুন, তাঁকে এর চেয়ে অনেক বেশি কষ্ট দেওয়া হয়েছে। তারপর তিনি ধৈর্য ধরেন।
লেখক : ড. সালমান আল আওদাহ
প্রকাশনী : গার্ডিয়ান পাবলিকেশন্স
বিষয় : সীরাতে রাসূল (সা.)
পৃষ্ঠা : 264, কভার : পেপার ব্যাক, সংস্করণ : 1st published 2020
Search Terms:
রাসুল (সাঃ) এর জীবনী,
রাসুল (সাঃ) এর জন্ম,
রাসূল (সাঃ) এর জীবনী বই pdf,
রাসুল সাঃ এর মৃত্যু,
সীরাতে রাসুল pdf,
সীরাত গ্রন্থ pdf,
হযরত মুহাম্মদ সাঃ এর জীবনী,
সীরাতে রাসূলুল্লাহ (সা) ইবনে ইসহাক pdf,
মাআল মুস্তফা pdf,
মা আল মুস্তফা বই pdf,
মা আল মুস্তফা pdf,