ভূমিকা
সমস্ত প্রশংসা সেই মহান রবের, যার কোন শরিক নেই। তিনি একক। সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। কুরআনুল কারীম অবতীর্ণকারী। গুনাহগার বান্দাদের পাপমােচনকারী। হাজার কোটি দরূদ ও সালাম আল্লাহর প্রিয় হাবীব মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের প্রতি। যার মাধ্যমে উম্মত পেয়েছে কুরআনের মতাে হিদায়াত-গ্রন্থ, ইসলামের মতাে তাওহীদবাদী দ্বীন এবং পরিপূর্ণ শরীয়ত৷ সেই সাথে তাঁর পরিবারবর্গ ও সহচরদের ওপর বর্ষিত হােক আল্লাহর খাস রহমত।
যারা নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছেন দ্বীনের জন্য। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য সংরক্ষণ করেছেন ইসলামের সবকিছু। তাদের ত্যাগ-তিতিক্ষার প্রতিদান আল্লাহর কাছে। মানবেতিহাসের সবচে আলােড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ হিসেবে যেই কিতাব ভাস্বর হয়ে আছে। তা হলাে পবিত্র কুরআনুল কারীম। এটি মুমিনের হিদায়াতের আলােক মিনার। অন্ধকার থেকে আলাের দিকে পথ দেখানাে একটি জ্বলন্ত মশাল। যে তার অনুসরণ করে, সে সৎপথপ্রাপ্ত৷ আর যে তার থেকে মুখ ঘুরিয়ে বিমুখ থাকে, সে অন্ধকারাচ্ছন্ন। এটি এমন এক কিতাব, যার শুরু থেকে শেষ সবটাই কল্যাণকর। কুরআনের ছায়াতলে যে আশ্রয় নেয়, তার মুক্তি সুনিশ্চিত। মানবজাতি যখন অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল, সেসময় এই কুরআনের আলাে দিয়ে আল্লাহর প্রিয় হাবীব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাদেরকে আলাের সন্ধান দিয়েছেন। জাহান্নামের সংকীর্ণ গলিপথ থেকে নিয়ে এসেছেন জান্নাতের প্রশস্ত রাস্তায়। মুসলিম উম্মাহ এই কুরআনকে যতদিন আঁকড়ে ধরেছিল, পথ হারায়নি। ভীরুমন হয়নি৷ পরাজিত হয়নি। হীনমন্যতা তাদের স্পর্শ করেনি৷
বেইজ্জতি তাদের কাছে ঘেঁষেনি। অপদস্থতা আর লাঞ্চনা কোন দিন তাদের পিছু নেয়নি। জিহাদের ময়দানে তারা পিছু হটেনি। শত্রুর মােকাবিলায় বুজদিল হয়নি৷ যেদিকেই গিয়েছে, সফলার পুষ্পমাল্য এসে অবস্থান নিয়েছে তাদের গলায়। বিজয়ী জাতি হিসেবে তারা মাথা উঁচু করে বেঁচে ছিল সর্বত্র। এরপর যখনই এই উম্মাহ কুরআনকে ছেড়ে দিয়েছে, কুরআনের শিক্ষাকে বিস্মৃত হয়েছে, কুরআন থেকে দূরে সরে গিয়েছে তখন থেকেই অধঃপতন আর লাঞ্চনা ও যিল্লতি তাদের সঙ্গী হয়েছে। সেজন্যই নতুন করে আবার হারানাে গৌরব ফিরে পেতে হলে উম্মাহকে ছুটে যেতে হবে কুরআনের কাছে। তিলাওয়াতের পাশাপাশি আল্লাহ প্রদত্ত নির্দেশনাগুলাে জানতে হবে, সেগুলাে নিয়ে ভাবতে হবে।। বৃটিশ বিরােধী আন্দোলনের অগ্রদূত শাইখুল হিন্দ মাহমুদ হাসান রাহিমাহুল্লাহ মাল্টার বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাবার পর নিজের উপলব্ধি তুলে ধরে যে কথাগুলাে বলেছিলেন তা অনেকটা এরকম, ‘মুসলিম উম্মাহর দুর্দশা নিয়ে আমি বন্দিদশায় অনেক ভেবেছি। আমার কাছে যে কারণটি স্পষ্ট হয়েছে তা হলাে, উম্মাহ কুরআন থেকে দূরে সরে গিয়েছে।
তাই আজ তারা এত লাঞ্চিত ও হীন। আমাদের সমাজের প্রাত্যহিক চিত্রের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অধিকাংশ মানুষই কুরআন পড়তে পারে না। যারা কুরআন পড়তে পারে, তারা আবার কুরআনের অর্থ বুঝে না। যারা কুরআনের অর্থ বুঝে, তারা আবার সেই অর্থের অন্তর্নিহিত মর্ম নিয়ে চিন্তা-ভাবনা ও তাদাব্দুর করে না। অথচ তিলাওয়াতের পাশাপাশি কুরআনের অর্থ বুঝে নেওয়া ও তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা ছাড়া কুরআনের হক পুরােপুরাে আদায় কখনাে সম্ভব নয়। বিষয়টি কুরআনের আয়াত, নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের হাদীস এবং সালাফে সালেহীনের বক্তব্য থেকে স্পষ্টভাবে বুঝে আসে৷ মূলত কুরআনের অর্থ বােঝা এবং তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার প্রতি মানুষকে উৎসাহিত করা, কুরআন বােঝার দ্বারা কী ধরনের উপকার লাভ হয় সেই বিষয়ে ধারণা দেওয়া ইত্যাদি বিষয়কে সামনে রেখেই আমি ধারাবাহিকভাবে লিখেছি “কুরআন বােঝার মজা' নামে একটি সিরিজ।
সেই সিরিজের বাইশটি লেখার মলাটবদ্ধ রূপই হলাে এই বইটি। কুরআনের সাথে মানুষের বন্ধনকে আরও সুদৃঢ় করার ছােট্ট একটি প্রয়াস এটি। আশা করি পাঠকসমাজ বইটি থেকে উপকৃত হবেন। কুরআনের সাথে তাদের হৃদয়ের বন্ধন গড়ে তুলবেন। আল্লাহ তাআলা বইটিকে কবুল করে নিন। এই বইটি ‘মুআসসাসাতুল কুরআন বাংলাদেশ’ নামক প্রতিষ্ঠানের জন্য ওয়াকফ করা হয়েছে। এর-থেকে-প্রাপ্ত রয়েলিটির মাধ্যমে কুরআনের আলাে সমাজের বুকে ছড়িয়ে
দেওয়ার কাজ আঞ্জাম দেওয়া হবে ইনশাআল্লাহ। কুরআনের সাথে সাধারণ মানুষের বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য নানান ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা এই প্রতিষ্ঠানের উদ্দেশ্য। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা এই খিদমতকে কবুল করুন এবং একে পরকালে নাজাতের উসিলা বানান। বইটি প্রকাশের শ্রমসাধ্য কাজটি আঞ্জাম দেওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করায় সমর্পণ প্রকাশনীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ। আল্লাহ তাআলা প্রকাশনীটিকে কবুল করে নিন এবং উম্মাহকে এর দ্বারা উপকৃত করুন। পাঠকদের কাছে অনুরােধ থাকবে, বইটিতে উপস্থাপিত কোন তথ্য বা বিষয় নিয়ে যদি কারও কোন আপত্তি, পরামর্শ বা উত্তম নির্দেশনা থাকে তবে অবশ্যই আমাকে অবহিত করবেন। আমি যারপরনাই কৃতজ্ঞ হবাে।
-আবদুল্লাহ আল মাসউদ কা'বা চত্বর, মসজিদুল হারাম, মক্কাতুল মুকাররমা,
২১ রবিউস সানি ১৪৪১ হিজরি
কুরআন বােঝার মজা
আরবি ভাষা জানার সবচেয়ে উপকারী দিক হলাে, কুরআন তিলাওয়াত করার সময় আল্লাহ তাআলা কী বলছেন তা আপনা-আপনি বােঝা যায়। কুরআন বুঝে পড়লে সেই তিলাওয়াত অনেক বেশি প্রভাব ফেলে অন্তরে। অপার্থিব এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে হৃদয়ের প্রতিটি অলিগলিতে৷ কখনও কখনও দেখা যায় নিজের অবস্থার সাথে অনেক আয়াত মিলে যায়। তখন মনে হতে থাকে, আমাকে উদ্দেশ্য করেই বুঝি এই কথাগুলাে আল্লাহ তাআলা বলেছেন! একদিন আমি সূরা মুমিনুন তিলাওয়াত করছিলাম। চেষ্টা করছিলাম তিলাওয়াতের ভেতর দিয়েই অর্থগুলাের প্রতি খেয়াল রাখতে৷ এই সূরার শেষের দিকে এসে একটা আয়াতে আমার চোখ আটকে গেল।
আমি একবার পড়লাম। দুইবার পড়লাম। বারবার পড়লাম। তৃপ্তিতে মনটা ভরে উঠল। মনে হলাে আত্মিক-প্রশান্তির-সরােবরে অবগাহন করে চলছি। সাঁতার কাটছি এপাশ থেকে ওপাশে, ওপাশ থেকে এপাশে। আমার কল্পনার পর্দায় ভেসে উঠছিল পরিচিত অনেক ভাইদের কথা। মনে পড়ে যাচ্ছিল। অজানা-অচেনা অনেক বােনদের কথা। যারা দ্বীন মানার কারণে আপন সমাজের কাছে উপহাসের পাত্র হয় মাঝে মধ্যে। আত্মীয়-স্বজনরা তাে বটেই, খােদ নিজ পরিবারের সদস্যরাও অনেক সময় তাদের নিয়ে উপহাস করে। তাদের দেখে টিপ্পনী কাটে। সুযােগ পেলেই দুই-চার কথা শুনিয়ে দিয়ে খোঁচা মারতে ভুলে না। আমি নিশ্চিত, এমন ভাই-বােনেরা কুরআনের আয়াতটা চোখের সামনে রাখলে এসব কিছু তাদের কাছে তুচ্ছজ্ঞান হবে।
আল্লাহ তাআলা বলেন,
“আমার বান্দাগণের মধ্যে একদল আছে, যারা বলে, “হে আমাদের রব, আমরা ঈমান এনেছি। অতএব আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও দয়া করুন। আর আপনি তাে সর্বশ্রেষ্ঠ দয়ালু।' কিন্তু তাদেরকে নিয়ে তােমরা এত ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে যে, তা তােমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছিল আমার স্মরণ। আর তােমরা তাদের নিয়ে হাসি-ঠাট্টাই করতে। নিশ্চয় আমি আজ তাদেরকে তাদের ধৈর্যের কারণে এমনভাবে পুরস্কৃত করলাম যে, তারাই হলাে সফলকাম।” [১]
এই-যে দ্বীন মানার কারণে প্রায়শই হাসি-ঠাট্টার শিকার হতে হয় আমাদেরকে এর বিনিময়ে আল্লাহ পরকালে আমাদেরকে পুরস্কৃত করবেন; এরচেয়ে বড়াে প্রাপ্তি আর কী হতে পারে? আজকে দাড়ি রাখার কারণে কেউ হয়তাে আমাদেরকে জঙ্গি বলছে, পর্দা করা শুরু করলে বলছে—লাদেন বাহিনীর সদস্য, পরকালের মহা-সফলতার বিপরীতে এমন তাচ্ছিল্য অত্যন্ত তুচ্ছ। একজন মমিন যখন করআনে এমন পরিষ্কার। ঘােষণা পায় তার মহান রবের পক্ষ থেকে, তখন কারও কোনাে ঠাট্টা-মশকরা-তামাশা তাকে মনঃক্ষুন্ন করতে পারে না। দ্বীনের পথে অবিচলতাকে টলাতে পারে না। কারণ সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, এখন যা-ই হােক না হােক, বেলাশেষে বিজয়ের পুষ্পমাল্য গলায় পরে সফলতার হাসিটা সে-ই হাসবে।। কুরআনের সাথে আমাদের আচরণ মন্ত্রের বইয়ের মতাে৷ খুললাম, গুনগুনিয়ে পড়লাম আর গিলাফে পুরে তাকে তুলে রেখে দিলাম। কী পড়লাম তা জানলাম না।
আল্লাহ তাআলা কী বলতে চাইলেন, তা বুঝলাম না। যার ফলে দেখা যায় কেউ একজন সকালে উঠে তিলাওয়াত করেছে। তার তিলাওয়াতকৃত-আয়াতে হারাম না-খাওয়া, সুদের বিরুদ্ধে আল্লাহর যুদ্ধ ঘােষণা করা ইত্যাদি বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত ছিল। কিন্তু সে এর কিছুই জানল না। ব্যস, কুরআন তিলাওয়াত শেষে মুসহাফটা গিলাফে প্যাঁচিয়ে ব্যাংক থেকে সুদ তুলতে রওনা হয়ে গেল কিংবা অফিসে ঘুষের জন্য আটকে-রাখা-ফাইলটা দফারফা করে কত ইনকাম হবে সে হিসাব কষতে বসে গেল। এসব কারণেই দেখা যায় কুরআন আমরা তিলাওয়াত করি কিন্তু কুরআনের শিক্ষা আমাদের বাস্তব জীবনে কোনাে প্রভাব ফেলে না। কুরআন বুঝে না পড়ার একটা কারণ হলাে, অনুবাদ বােঝা বা তাফসীর পড়ার জন্য আলাদাভাবে সময় ব্যয় করতে হয়। আমরা তাে সবাই আজকাল ত্রস্ত-ব্যস্ত। রাজ্যের কাজকাম নিয়ে ঘুরিফিরি। তাই এত সময় কই আমাদের হাতে।
এই কারণে আরবি ভাষা জানা থাকলে বাড়তি ফায়দা পাওয়া যায়। অনুবাদের জন্য আলাদা সময় বের করতে না পারলেও সমস্যা নাই৷ তিলাওয়াতের সময় ধ্যানটা একটু অর্থের দিকে ঘুরিয়ে দিলেই হয়ে যায়। মূলত কুরআন তিলাওয়াত একটা স্বতন্ত্র ইবাদাত। সেই কুরআনে আল্লাহ তাআলা কী বললেন তা জানা ও সেই আদেশ-নিষেধ-উপদেশ নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা ভিন্ন ইবাদাত৷ দুইটার জন্যই আলাদা আলাদা সাওয়াব রয়েছে। অনেককেই দেখা যায় সারা বছর কয় খতম করলেন সেই হিসেবে মত্ত থাকে। খতম তােলার সংখ্যাটা মােটাতাজা করাটাই তাদের কাছে মুখ্য। এটাই তাদের সুখ দেয় ও মনের ভেতর তৃপ্তির ঢেকুর জাগ্রত করে। অথচ সারা বছর অর্থ না বুঝে তিন খতম তিলাওয়াত করার চেয়ে অর্থসহ পড়ে এক খতম তিলাওয়াত করাটাই শ্রেয়। কারণ এতে ভিন্নধর্মী দুই ইবাদাতের সম্মিলন ঘটছে। নিশ্চয়ই একই স্বাদের খানা দিয়ে পেটের পুরােটা ভরাট করার চেয়ে এক স্বাদের খানা দিয়ে অর্ধেক, আর অন্য আরেক স্বাদের খানা দিয়ে বাকি অর্ধেক পুরা করা বুদ্ধিমানের কাজ।
কুরআন বুঝে পড়ার সবচেয়ে মজার দিক হলাে, আপনি হঠাৎ হঠাৎ দেখবেন এমন কিছু কথার সম্মুখীন হচ্ছেন যেন এগুলাে সরাসরি আপনাকে বলা হচ্ছে। কিংবা যেন আপনার অবস্থাটাই আয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। ধরুন, আপনার মাথায় কোনাে একটা গুনাহ করার চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। সে গুনাহতে আপনি এখনও জড়াননি। তবে জড়াবেন জাড়বেন অবস্থা। এর মধ্যেই আপনি কুরআন তিলাওয়াত করতে বসলেন। আপনার সামনে এলাে এই আয়াত :
“আর যে তার রবের সামনে দাঁড়ানােকে ভয় করে এবং নিজেকে কুপ্রবৃত্তির বাসনা চরিতার্থ করা থেকে বিরত রাখে তার অবস্থানস্থল হলাে জান্নাত।”[২]
আপনি নিশ্চিত জেনে রাখুন, তখন এই আয়াত আপনার হৃদয়-নদে চিন্তার ঢেউ। তুলবে। আপনাকে ভাবনার অতল সমুদ্রে ছুড়ে মারবে। বাধ্য করবে এভাবে চিন্তা করতে, একদিকে আমার সামনে জান্নাতের হাতছানি, অপরদিকে পাপের সাময়িক স্বাদের লােভ। কোনটা ছেড়ে কোনটা ধরি? বারবার এই আয়াতটা তিলাওয়াত করতে থাকুন এবং আপন মনে হিসেব কষতে থাকুন। একবার, দুইবার, তিনবার, বারবার বারবার। দেখবেন আপনি হৃদয়ের গহীনে ঐশ্বরিক শক্তির অনুভূতি টের পাবেন। নিজের পাপের ইচ্ছার মুখে লাগাম পরানাে তখন আপনার ‘বায়ে হাত কা খেল’ হয়ে যাবে।
সুতরাং কুরআন বােঝার কোনাে বিকল্প নাই। কুরআন না বােঝা মানে হৃদয়ের দরজা তালাবদ্ধ হওয়া। যেই দরজা দিয়ে কখনও কল্যাণ-চিন্তার আগমন ঘটবে না। নিত্যনতুন মঙ্গলজনক ভাবনার উদয় হবে না। যে হৃদয় তালাবদ্ধ সে হৃদয় মাহরূম। আল্লাহ কুরআনে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন,
“তারা কি কুরআন নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করবে না, নাকি তাদের অন্তরগুলাে তালাবদ্ধ?”[৩]
বড়াে মায়ময় প্রশ্ন। যার থেকে ঝরে পড়ে অভিমানের ছটা। কেমন যেন এত বড়াে দৌলত পেয়েও আমাদের গাফিল হয়ে থাকার ফলে আল্লাহ তাআলা শ্লেষাত্মকভঙ্গিতে বললেন কথাটা৷ অনেকে আবার অদ্ভুত চিন্তা লালন করেন। কুরআনের অনুবাদ পড়ার পক্ষপাতী নন তারা। এ যেন হিন্দু ধর্মের পুরােহিততন্ত্রের ইসলামি সংস্করণ। কুরআনের অর্থই যদি না পড়ে, তবে কুরআনের মর্ম নিয়ে ভাববে কীভাবে? যদি বলেন, এই ভাবনার দরকার নাই তা হলে প্রশ্ন আসে, না ভাবলে হৃদয় তালাবদ্ধ হয়ে থাকার কথা আল্লাহ তাআলা কেন বললেন?
বুঝা গেল এটা বিবেচনাহীন কথা। বরং আমাদের অর্থ পড়তে হবে। কুরআন বুঝতে হবে। কুরআন নিয়ে ভাবতে হবে। তবে হ্যাঁ, কোনাে কিছু বুঝে আসলে বা জটিল মনে হলে আলিমদের কাছে যেতে হবে। নিজে নিজে পণ্ডিতি করার সুযােগ নাই। হয়তাে কেউ কেউ স্ব-পণ্ডিত হয়ে যান বিধায় অনেকে কুরআনের অনুবাদ পড়তে বারণ করেন। এটা কেমন যেন মাথাব্যথার চিকিৎসা-স্বরূপ মাথা কেটে ফেলার ব্যবস্থাপত্রের মতােই। আমাদেরকে এ-সকল প্রান্তিকতার বৃত্ত থেকে মুক্ত হয়ে মধ্যমপন্থা অবলম্বন করতে হবে। এটিই হলাে সীরাতে মুস্তাকীম।। কয়েক বছর আগে রমাদানে তারাবির পর প্রতিদিন-পঠিত অংশের এক দুই আয়াত নিয়ে কিছু কথা আলােচনা করতে হতাে আমাকে।
শেষের দিন আমি চাইলাম মুসল্লিদেরকে এমন কিছু বলি যা সুদূরপ্রসারী হবে। তাদেরকে যা বলেছিলাম সেগুলােই এখানে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। সূরা ফাতিহা হলাে কুরআন-নামক শহরের প্রবেশ পথ। তারপরের সূরাটির নাম বাকারা। যার মানে হলাে গরু। এটি একটি নির্বোধ প্রাণি। যার ভালাে-মন্দ, সঠিকবেঠিক ও কল্যাণ-অকল্যাণের কোনাে জ্ঞান নেই। তাকে ডানে যেতে বলা হলে সে যায় বামে। বামে যেতে বলা হলে যায় ডানে। সে বৈধ-অবৈধ বুঝে না। যার-তার ফসলে মুখ ঢুকিয়ে দেয়। তাে কেমন যেন, একজন মানুষ কুরআনের সংস্পর্শে আসার আগপর্যন্ত। তার অবস্থা একটা নির্বোধ গরুর মতােই। তার মধ্যে ভালাে-মন্দ ও সঠিক-বেঠিকের। কোনাে জ্ঞান থাকে না। তার জীবনটা হয় স্বেচ্ছাচারিতায় পরিপূর্ণ। তারপর গরুর মতাে নির্বোধ একজন ব্যক্তি কুরআন-নামক শহরটির রাস্তা ধরে এগােতে থাকে। আস্তে আস্তে এক আয়াত করে করে সামনে বাড়তে থাকে এবং সেসব আয়াতে পাওয়া হুকুম-আহকাম, আদেশ-নিষেধ, উপদেশ-নসিহতগুলাে গ্রহণ করে নেয়। নিজের জীবনে সেগুলাের বাস্তবায়ন ঘটায় এবং দেখতে দেখতে একসময় সে শহরের শেষ ফটকে পৌঁছে যায়।
যার নাম হলাে সূরা নাস। নাস শব্দটি ইনসান শব্দের বহুবচন। এর অর্থ হলাে মানুষ। তার মানে যে-লােকটি কুরআনের কাছে আসার সময় গরুর মতাে নির্বোধ ছিল, তার ভালাে-মন্দের জ্ঞান ছিল না, পুরাে শহর ঘুরে শেষ প্রান্তে আসার পর এখন আর সে গরুর মতাে নির্বোধ নয়। বরং জ্ঞানসম্পন্ন একজন। মানুষে পরিণত হয়েছে। তার এখন সঠিক-বেঠিকের বুঝ আছে। কুরআনের সূরাগুলাের ধারাবিন্যাসের মাঝেই কেমন যেন আমাদেরকে এই ইঙ্গিতটা দেওয়া হয়েছে। প্রশ্ন হলাে, বহু লােককেই তাে দেখি সারা জীবন বহুবার কুরআন খতম করেছেন। কিন্তু কই, তারা তাে মানুষের কাতারে আসতে পারেনি! কুরআন তার জীবনে কোনাে পরিবর্তনই আনেনি। সে আগের মতােই মিথ্যা বলে। মানুষকে গালি দেয়। মা-বাবাকে কষ্ট দেয়। সুযােগ পেলে চুরি করে। অন্যের সম্পদ মেরে দেয়। গরুর মতােই সে নির্বোধ। রয়ে গেছে। আসলে খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এই লােক শুধুই কুরআন অন্ধের মতাে পড়ে গেছে।
এর অর্থ জানার চেষ্টা করেনি কোনােদিন। সকালে সে যে-আয়াতগুলাে তিলাওয়াত করেছে সেখানে বলা হয়েছিল, তােমরা মাবাবাকে ‘উফ’ পর্যন্ত বােলাে না। অথচ সে কুরআন তিলাওয়াতটা শেষ করেই মাবাবার সাথে কটুবাক্যে কথা বলা শুরু করল। একটু আগে সে পড়েছিল, আল্লাহর নাফরমানি কোরাে না। তবে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সে কুরআনটা গিলাফে ভরেই টিভির রিমােট হাতে নিয়ে হিন্দি সিনেমা দেখতে বসে গেল; কিংবা অফিসে গিয়ে ঘুষ নেওয়ার ধান্ধায় ডুবে গেল।
[১] সূরা মুমিনূন : ১০৯-১১১
[২] সূরা নাযিআত : ৪০-৪১
[৩] সূরা মুহাম্মাদ : ২৪
লেখক : আবদুল্লাহ আল মাসউদ
প্রকাশনী : সমর্পণ প্রকাশন
বিষয় : কুরআন বিষয়ক আলোচনা
মোট পৃষ্ঠা : ১৬০
কভার: পেপার ব্যাক